Malnutrition

পুষ্টিহীনতা, এর কারণ ও সমাধান

পুষ্টিহীনতা (Malnutrition) 
পুষ্টিহীনতা বলতে সাধারণত দেহে পুষ্টিকর খাদ্যের বা প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবকেই বোঝায়মানুষ ও অন্যান্য জীব যা খেয়ে জীবন ধারণ করে, তাকে খাদ্য বলেযে প্রক্রিয়ায় জীবদেহে খাদ্য পরিপাক ও পরিশোধিত হয়ে দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে, দেহের প্রবৃদ্ধি সাধন, রক্ষণাবেক্ষণ ও শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে, তাকেই পরিপুষ্টি বা পুষ্টি বলেশিশু বয়স থেকেই সুষম খাদ্য গ্রহণ না করলে মানব দেহ সুস্থ্য ও সবলভাবে গড়ে উঠতে পারে নাযে খাদ্যে মানবদেহের প্রয়োজণীয় শর্করা, স্নেহ, আমিষ খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি এ ছয়টি উপাদান পাওয়া যায়, তাকে সুষম খাদ্য বলেমানবদেহের প্রয়োজন মোতাবেক খাদ্যের এ উপাদানসমূহ না পেলেই পুষ্টিহীনতার সৃষ্টি হয় বা পুষ্টির অভাব দেখা দেয়বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র ও জনবহুল দেশএ দেশের অধিকাংশ জনগণই নিরক্ষরপুষ্টি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নেই বললেই চলেস্বাস্থ্যকে সুস্থ্য ও কর্মক্ষম রাখতে হলে পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক

বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার কারণ (Cause of Malnutrition)
বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পুষ্টিহীনতা অন্যতমএ পুষ্টিহীনতাকে একটি মারাত্মক জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছেবিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম এবং দেশব্যাপী পুষ্টি জরিপের মাধ্যমে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে১৯৮১-৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত পুষ্টি জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, ১১ বছর পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে ৭৫% শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভোগে১৩% শিশু একই সময়ে বয়সের তুলনায় খাট এবং উচ্চতার তুলনায় কম ওজনবিশিষ্টএসব শিশু বিভিন্ন প্রকার অপুষ্টিজনিত রোগের স্বীকার হয়ে থাকেযথোপযুক্ত চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাবে অকালেই এসব শিশু মৃত্যুবরণ করে৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে ৭৩% ৬/১৪ বছরের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে ৭৫% সাধারণ মহিলাদের মধ্যে ৭৪% এবং পূর্ণ বয়স্ক পরুষদের মধ্যে ৬০% রক্ত শূণ্যতায় ভোগেএ দেশের ১০% লোক বিশেষ করে মহিলারা আয়োডিন নামক খনিজ লবণের অভাবজনিত ঘ্যাগ বা গলগন্ড রোগে ভোগেবাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার মৌলিক কতগুলো কারণ নিম্নে দেয়া হলঃ
অর্থনৈতিক কারণঃ আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণই দরিদ্রঅর্থের অভাবে ইচ্ছে এবং চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ ও গ্রহণ করতে পারে না অর্থের অভাবে তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিতফলে তারা খাদ্যের পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কেও অজ্ঞ থাকে
খাদ্য সম্বন্ধে অজ্ঞতাঃ পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে এবং অজ্ঞতার কারণে বাঙ্গালীর যখন যা হাতের কাছে পায়, তা দিয়েই ক্ষুধা মিটিয়ে থাকেকিন্তু খাদ্যের সাথে শরীর সুস্থ্য রাখার একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছেঅজ্ঞতা ও কুসংস্কার এর কারণে আমাদের হাতের কাছে অনেক পুষ্টিকর খাবার থাকার পরও আমরা তা গ্রহণ করি নাস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কি খাওয়া উচিত এ জ্ঞান অনেকেরই নেই
জনসংখ্যা বিস্ফোরণঃ অধিক জনসংখ্যা পুষ্টিহীনতার একটি অন্যতম কারণপরিবারের আকার বড় থাকার ফলে পরিবারের সদস্যদের জন্য সু-শিক্ষা সু-চিকিৎসা ও দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী সুষম খাদ্যের যোগান দেয়া সম্ভব হয় না ফলে তারা পুষ্টিহীনতার শিকার হয়
ত্রুটিপূর্ণ রন্ধন প্রণালীঃ আমাদের দেশের মহিলারা রন্ধন পদ্ধতি সম্পর্কে একেবাবে অজ্ঞরান্নার পূর্বে কাটা বাছা এবং ধোয়ার সময় অনেকটা ভিটামিন নষ্ট করে ফেলেআবার রান্নার সময় অধিক উচ্চতাপে রান্না ঢেকে না রেখে খোলা রাখা ইত্যাদি কারনেও খাবারের ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়খাদ্যবস্তুকে অধিক মুখরোচক করতে গিয়েও তারা অধিক পরিমাণ তেল এবং মসলা ব্যবহার করে আর অধিকক্ষণ তাপে রাখে, যার ফলে খাবারের পুষ্টিমান নষ্ট হয়ে যায়
অসম বন্টনঃ আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, ছেলে প্রীতির কারণে অর্থাৎ একটি ছেলেকে সুস্থ্যভাবে গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তীকালে সে সংসারের হাল ধরতে পারবে বংশ রক্ষা হবে ইত্যাদি কারনে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের বেশি বেশি খাবার দেয়া হয়আবার অনেক সময় দেখা যায়, মাছের মুড়টি ছেলে মেয়ে কাউকে না দিয়ে বাড়ির মুরব্বিকে দেয়া হয়
মায়ের উদাসীনতাঃ শিশুদের পুষ্টিহীনতার পেছনে খাবার সম্বন্ধে মায়েদের অজ্ঞতা এবং উদাসীনতাও অন্যতম কারণজন্মের পর শিশু সম্পূর্ণরূপে মায়ের ওপর নির্ভরশীলশিশুকে কখন কি খাবার দিতে হবে, কিভাবে খাওয়াতে হবে কখন পরিপূরক খাবার দিতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে মা যদি সচেতন না হন তবে শিশু অপুষ্টির স্বীকার হবে
ভোজন বিলাসীঃ শরীরের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে এবং অধিক পরিমাণ গরু পাক খাদ্য গ্রহণ করলে শরীর বিভিন্ন প্রকার রোগ হতে পারেযেমনঃ হৃদরোগ, অধিক রক্তচাপ ইত্যাদি
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাঃ আমাদের দেশের অধিকাংশ মায়েরাই শিশুদের হাত, মুখ না ধুয়ে খাবার খাওয়ায়পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে তাদের তেমন কোন শিক্ষা দেয়া হয় নাফলে অপরিষ্কার হাতে পচা, খোলা, বাসি খাবার খেয়ে বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পুষ্টিহীনতার স্বীকার হয়
খাদ্যের দুর্মূল্যঃ শাক-সবজি ও মাছ মাংস সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অত্যধিক দুর্মূল্য এর কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকের পক্ষে প্রয়োজণীয় প্রোটিন ও ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে নাফলে তারা প্রোটিন ও ক্যালরির অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগে


প্রোটিন, ক্যালরির অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বেশির ভাগ শিশুর মধ্যে দেখা যায়সাধারণত প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব হলে দেহে যে সকল রোগ দেখা দেয় সেগুলো হলঃ কোয়াশিয়রকর, রাতকানা, ম্যারসমাস, বেরিবেরি, চক্ষুরোগ, স্কার্ভিরোগ, রক্তশূন্যতা, গলগন্ড ইত্যাদিএসকল রোগ পুষ্টিহীনতার ফলেই হয়ে থাকেপুষ্টিহীনতা সমস্যাকে কোন অবস্থাতেই অবহেলা করা উচিত নয়এ সমস্যা সমাধানের জন্য WHO, FAO, UNICEF প্রভৃতি সংস্থা চেষ্টা চালাচ্ছেআমাদের নিজেদেরও এ সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে



পুষ্টি সমস্যা সমাধানের উপায়সমূহ 
দরিদ্রতার শিকার আমাদের বাংলাদেশে পুষ্টি সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো নেম্নে দেয়া হলঃ
জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করা
শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা
স্বাস্থ্য রক্ষার উপায় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা
পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করা
মা ও শিশুর স্বাস্থ্যে যত্ন নেয়া
সু-চিকিৎসার বন্দোবস্তা করা
সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা করা
মাতৃদুগ্ধ পান করা
খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করা।‌
১০রন্ধন প্রণালীর পরিবর্তন করা
১১ভেজাল খাবার পরিহার করা
১২পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা
১৩সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে খাবারের মেনু তৈরী করা
১৪গবেষণার মাধ্যমে  উন্নতমানের পুষ্টিকর খাদ্য আবিষ্কার করা
১৫উন্নত খাদ্য সংরক্ষন প্রণালী প্রবর্তন করা  

  • Digg
  • Del.icio.us
  • StumbleUpon
  • Reddit
  • RSS

0 comments:

Post a Comment